
কালোজিরা,- প্রায় সকল রোগের ক্ষেত্রেই যার আছে ঔষধি গুণ। বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সাঃ) বলেছেন, “তোমরা কালোজিরা ব্যবহার করবে, কেননা এতে একমাত্র মৃত্যু ব্যতীত সর্ব রোগের মুক্তি রয়েছে”। প্রাচীনকাল থেকেই নানা অসুখ-বিসুখে কালো জিরাকে ওষুধ হিসেবে ব্যবহার করে আসছেন চিকিৎসক-কবিরাজরা। দেখতে কালো হলেও প্রকৃতপক্ষে এটি প্রায় সব অসুখেই কাজে আসে। আসুন আজকে জেনে নেই কালো জিরার কিছু গুণাগুণঃ

কালোজিরা খুব পরিচিত একটি নাম। কালোজিয়া শুধু ছোট ছোট কালো দানা নয়, এর মধ্যে রয়েছে অন্যন্য গুনের এক বিস্ময়কর শক্তি। ছোট ছোট কালো দানাগুলোর মধ্যে সৃষ্টিকর্তা যে কি বিশাল ক্ষমতা নিহিত রেখেছেন তা সত্যিই বিষ্ময়কর। প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরা মানবদেহের বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক ও প্রতিরোধক। কালোজিরা চুলপড়া, মাথাব্যথা, অনিদ্রা, মাথা ঝিমঝিম করা, মুখশ্রী ও সৌন্দর্য রক্ষা, অবসন্নতা-দুর্বলতা, নিষ্ক্রিয়তা ও অলসতা, আহারে অরুচি এবং মস্তিষ্ক শক্তি তথা স্মরণশক্তি বাড়ানোসহ সকল প্রকার রোগের মহৌষধ।
কালিজিরার ইংরেজি নাম Fennel flower, Nutmeg flower, Roman Coriander, Blackseed or Black caraway। অন্যান্য বাংলা নাম কালিজিরা, কালোজিরা, কালো কেওড়া, রোমান ধনে, নিজেলা, কালঞ্জি এসব। যে নামেই ডাকা হোক না কেন এ কালো বীজের গুণাগুণ স্বাস্থ্য উপকারিতা অপরিসীম অসাধারণ কালজয়ী। কালিজিরার আদি নিবাস দক্ষিণ ও দক্ষিণপূর্ব এশিয়া। কেউ কেউ বলেন ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে এর উৎপত্তি স্থান।
কালোজিরায় কি কি উপাদান বিদ্যমানঃ
কালিজিরার তেলে ১০০টিরও বেশি উপযোগী উপাদান আছে। এতে আছে প্রায় ২১ শতাংশ আমিষ, ৩৮ শতাংশ শর্করা এবং ৩৫ শতাংশ ভেষজ তেল ও চর্বি। কালিজিরার অন্যতম উপাদানের মধ্যে আছে নাইজেলোন, থাইমোকিনোন ও স্থায়ী তেল। এতে আরও আছে আমিষ, শর্করা ও প্রয়োজনীয় ফ্যাটি এসিডসহ নানা উপাদান এবং কালিজিরার তেলে আছে লিনোলিক এসিড, অলিক এসিড, ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, জিংক, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়াম, ভিটামিন-এ, ভিটামিন-বি, ভিটামিন-বি২, নিয়াসিন ও ভিটামিন-সি। এর মধ্যে রয়েছে ফসফেট, লৌহ, ফসফরাস, কার্বো-হাইড্রেট ছাড়াও জীবাণু নাশক বিভিন্ন উপাদান সমূহ। এতে রয়েছে ক্যন্সার প্রতিরোধক কেরোটিন ও শক্তিশালী হর্মোন, প্রস্রাব সংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, পাচক এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান এবং অম্লরোগের প্রতিষেধক।
বিশেষজ্ঞদের মতে, “কালোজিরায় রয়েছে-ফসফেট, লৌহ, ফসফরাস, কার্বো-হাইড্রেট ছাড়াও জীবাণুনাশক বিভিন্ন উপাদান। কালোজিরায় ক্যান্সার প্রতিরোধক কেরোটিন ও শক্তিশালী হরমোন, প্রস্রাবসংক্রান্ত বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধকারী উপাদান, পাচক এনজাইম ও অম্লনাশক উপাদান এবং অম্লরোগের প্রতিষেধক।” আয়ুর্বেদিক ও কবিরাজি চিকিৎসাতেও কালোজিরার ব্যবহার হয়। কালোজিরার বীজ থেকে একধরণের তেল তৈরি হয়, যা আমাদের শরীরের জন্য অত্যন্ত উপকারী। এছাড়াও কালোজিরা বিভিন্ন রোগের হাত থেকে দেহকে রক্ষা করে ৷
কালোজিরার ব্যবহার ও উপকারিতাঃ
সর্ব রোগের ঔষধ বলা হয় কালোজিরাকে। অনেক পুষ্টিবিদ ও খাদ্যবিজ্ঞানীরাও বলেন, প্রতিদিন কালোজিরা খেতে পারলে শরীরের নানা অসুখের সঙ্গে লড়াই করা সহজ হয়। আসুন জেনে নিই কালোজিরা কিভাবে খেলে কোন কোন রোগের ক্ষেত্রে উপকার পাওয়া যাবে তার বিস্তারিত-
মাথাব্যথাঃ মাথা ব্যথায় কপালে উভয় চিবুকে ও কানের পার্শ্ববর্তী স্থানে দৈনিক ৩-৪ বার কালোজিরার তেল মালিশ করুণ। তিন দিন খালি পেটে চা চামচে এক চামচ করে তেল পান করুন উপকার পাবেন।
কফ ও হাঁপানিঃ বুকে ও পিঠে কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এ ক্ষেত্রে হাঁপানিতে উপকারী অন্যান্য মালিশের সঙ্গে এটি মিশিয়েও নেয়া যেতে পারে।
স্মৃতিশক্তি বাড়ে ও অ্যাজমায় উন্নতি ঘটেঃ এক চামচ মধুতে একটু কালোজিরা দিয়ে খেয়ে ফেলুন। এতে স্মৃতিশক্তি বৃদ্ধি পায়। হালকা উষ্ণ পানিতে কালোজিরা মিলিয়ে ৪৫ দিনের মতো খেলে অ্যাজমার সমস্যার উন্নতি ঘটে।
ডায়াবেটিসে কালোজিরাঃ কালোজিরার চূর্ণ ও ডালিমের খোসা চূর্ণ মিশ্রণ এবং কালোজিরার তেল ডায়াবেটিসে উপকারী।
মেদ ও হৃদরোগঃ চায়ের সঙ্গে নিয়মিত কালোজিরা মিশিয়ে অথবা এর তেল মিশিয়ে পান করলে হৃদরোগে যেমন উপকার হয়, তেমনি মেদ কমে যায়।
যৌন দুর্বলতায় কালোজিরার ব্যবহারঃ কালোজিরা চুর্ণ ও অলিভ অয়েল, ৫০ গ্রাম হেলেঞ্চার রস ও ২০০ গ্রাম খাঁটি মধু একসঙ্গে মিশিয়ে সকালে খাবারের পর এক চামুচ করে খান। এতে গোপন শক্তি বৃদ্ধি পাবে।
সর্দি-কাশি নিরাময়ে কালোজিরাঃ সর্দি-কাশি রুখতে কালোজিরা দিয়ে ঘরোয়া চিকিৎসা নতুন কিছু নয়। একটি পরিষ্কার কাপড়ে কালোজিরা নিয়ে তা নাকের কাছে ধরে বড় করে শ্বাস টানুন কিছুক্ষণ। এর ঝাঁজ বুকে জমে থাকা শ্লেষ্মাকে টেনে বার করতে সাহায্য করে। নাক বন্ধের সমস্যাতেও এই উপায়ের জুড়ি মেলা ভার।
চুলপড়ারোধে কালোজিরাঃ লেবু দিয়ে সব মাথার খুলি ভালোভাবে ঘষুণ। ১৫ মিনিট পর শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে ফেলুন ও ভালোভাবে মাথা মুছে ফেলুন। তার পর মাথার চুল ভালোভাবে শুকানোর পর সম্পূর্ণ মাথার খুলিতে কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এতে এক সপ্তাহেই চুলপড়া কমে যাবে।
অ্যাসিডিটি ও গ্যাস্টিকঃ এক কাপ দুধ ও এক টেবিল চামুচ কালোজিরার তেল দৈনিক তিনবার ৫-৭ দিন সেবন করতে হবে। এতে গ্যাস্টিক কমে যাবে।
চোখের সমস্যায় কালোজিরাঃ রাতে ঘুমানোর আগে চোখের উভয়পাশে ও ভুরুতে কালোজিরার তেল মালিশ করুণ। এক কাপ গাজরের রসের সঙ্গে এক মাস কালোজিরা তেল সেবন করুন।
উচ্চ রক্তচাপঃ যখনই গরম পানীয় বা চা পান করবেন, তখনই কালোজিরা খাবেন। গরম খাদ্য বা ভাত খাওয়ার সময় কালোজিরার ভর্তা খান রক্তচাপ স্বাভাবিক থাকবে। এ ছাড়া কালোজিরা, নিম ও রসুনের তেল একসঙ্গে মিশিয়ে মাথায় ব্যবহার করুণ। এটি ২-৩ দিন পরপর করা যায়।
জ্বরঃ সকাল-সন্ধ্যায় লেবুর রসের সঙ্গে এক টেবিল চামুচ কালোজিরা তেল পান করুণ। আর কালোজিরার নস্যি গ্রহণ করুন।
স্ত্রীরোগঃ প্রসব ও ভ্রুণ সংরক্ষণে কালোজিরা মৌরী ও মধু দৈনিক ৪ বার খান।
সৌন্দর্য বৃদ্ধিঃ অলিভ অয়েল ও কালোজিরা তেল মিশিয়ে মুখে মেখে এক ঘণ্টা পর সাবান দিয়ে ধুয়ে ফেলন।
মানসিক বিকাশঃ শিশুদের কালোজিরা খাওয়ানোর অভ্যাস করলে দ্রুত শিশুর দৈহিক ও মানসিক বৃদ্ধি ঘটে।
ব্লাড প্রেশার নিয়ন্ত্রনেঃ ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রনে রাখতে প্রতিদিন সকালে দু’কোয়া রসুন চিবিয়ে খেয়ে, সারা শরীরে কালোজিরার তেল মালিশ করে রোদে আধ ঘণ্টা বসে থাকুন। পাশাপাশি ১ চা চামচ কালোজিরার তেলে ১ চা চামচ মধু মিশিয়ে খেলেও ব্লাড প্রেসার নিয়ন্ত্রণে থাকে।
বাত ব্যথাঃ পিঠে ও অন্যান্য বাতের বেদনায় কালোজিরার তেল মালিশ করুন। এ ছাড়া মধুসহ প্রতিদিন সকালে কালোজিরা সেবনে স্বাস্থ্য ভালো থাকে।
দাঁত শক্ত করেঃ দই ও কালোজিরার মিশ্রণ প্রতিদিন দুবার দাঁতে ব্যবহার করুন। এতে দাঁতে শিরশিরে অনুভূতি ও রক্তপাত বন্ধ হবে।
ওজন কমায়ঃ যারা ওজন কমাতে চান, তাদের খাদ্য তালিকায় উষ্ণ পানি, মধু ও লেবুর রসের মিশ্রণ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। এখন এই মিশ্রণে কিছু কালোজিরা পাউডার ছিটিয়ে দিন। পান করে দারুণ উপকার পাবেন।
এছাড়াও নিয়মিত কালোজিরা সেবনে চুলের গোড়ায় পুষ্টি ঠিকমতো পায়, ফলে চুলের বৃদ্ধি ভালো হয় এবং চুল পড়া বন্ধ হয়। অনেকেরই চুল পড়া, দুর্বল চুল, শুষ্ক চুল ইত্যাদি নানা রকম সমস্যা থাকে। এক্ষেত্রে সপ্তাহে কয়েকবার কালিজিরার তেলের ব্যবহার চুলের সমস্যাকে দূর করতে পারে। কালোজিরার তেলে রয়েছে ক্ষুধা বাড়ানোর উপাদান। অন্ত্রের জীবাণুকে নাশ করে শরীরে জমে থাকা গ্যাসকে দূর করতে কালোজিরার বিকল্প নেই।
বাংলাদেশে কালিজিরার গবেষণা ও সম্প্রসারণ
প্রাচীনকাল থেকে কালোজিরার চাষাবাদ হয়ে থাকলেও বাংলাদেশে অতীতে কালিজিরা নিয়ে উল্লেখযোগ্য কোনো গবেষণা পরিলক্ষিত হয়নি বললেই চলে। তবে মসলা গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা লাভের পর থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে জার্মপ্লাজম সংগ্রহ কার্যক্রম শুরু হয় এবং ১৯৯৭-৯৮ সাল হতে মূল্যায়ন ও বাছাই পরীক্ষার মাধ্যমে। পরবর্তীতে প্রাথমিক ফলন পরীক্ষা, অগ্রবর্তী ফলন পরীক্ষা ও আঞ্চলিক ফলন পরীক্ষার মাধ্যমে পূর্ণাঙ্গ যাচাই বাছাই করে ২০০৯ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট কর্তৃক “বারি কালিজিরা-১” নামে কালোজিরার একটি উচ্চ ফলনশীল জাত চাষাবাদের জন্য উদ্ভাবন করা হয় এবং এর সাথে সংশ্লিষ্ট সার, সেচ ও রোগ বালাই ব্যবস্থাপনাসহ অন্যান্য উৎপাদন প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়।
জাত উদ্ভাবনের পর বিগত বছরগুলোতে এর বীজ উৎপাদন প্রক্রিয়া আরম্ভ হয়। কৃষক পর্যায়ে সম্প্রসারণের লক্ষ্যে বিগত বছরগুলোতে বারি কালিজিরা-১ এর মানসম্পন্ন বীজ উৎপাদন এবং বীজ বিতরণ করা হয়। বিভিন্ন গবেষণা কার্যক্রমে ব্যবহার, বেসরকারি সংস্থায় সরবরাহ, বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রছাত্রী উচ্চশিক্ষা গবেষণা এবং পরবর্তী মৌসুমে গবেষণা কাজের জন্য কালিজিরা বীজ সংরক্ষণ করা হয়। এছাড়া বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় ব্লক প্রদর্শনী স্থাপন করে চলেছে এবং এ ব্যাপারে কৃষকদের মাঝে চাষের উৎসাহ প্রদান করা হচ্ছে।
বাংলাদেশে কালিজিরা চাষের সম্ভাবনা
বাংলাদেশের মাটি এবং জলবায়ু কালিজিরা চাষের জন্য উপযোগী। দেশের উত্তরাঞ্চলে বিশেষ করে লালমনিরহাট, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুরের চরাঞ্চলে উন্নত জাতের কালিজিরার চাষ সম্প্রসারণ করা যেতে পারে। কালিজিরা চাষাবাদে সেচ কম দিতে হয়, কখনও ১/২ টি সেচে ভালো ফলন পাওয়া যায় বিধায় বরেন্দ্র এলাকায় এর চাষাবাদ বৃদ্ধি করার উল্লেখযোগ্য সম্ভাবনা রয়েছে। চলনবিল এলাকায় পানি নেমে যাওয়ার পর সেখানে কালিজিরা চাষ করা যেতে পারে।
ফরিদপুর, রাজশাহী, পাবনা এলাকার চাষিরা পেঁয়াজ বীজ উৎপাদন করে। পেঁয়াজ বীজ ক্ষেতের চারপাশে এবং ক্ষেতের ভেতর পেঁয়াজের ১০-১৫ সারি পর কালিজিরা বপন করা যায়। এতে কালিজিরার উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে। তাছাড়া অন্যান্য রবি ফসলের ক্ষেতের চারপাশেও কালিজিরা বপন করা যেতে পারে। কালিজিরা একটি অর্থকরী এবং বহুগুণে গুণান্বিত উচ্চমাণসম্পন্ন পুষ্টিকর মসলা জাতীয় ফসল।
সূত্রঃ যুগান্তর ও কৃষি তথ্য সার্ভিস (এআইএস)