যুক্তরাজ্যের রয়্যাল ইনস্টিটিউট অব ব্রিটিশ আর্কিটেক্টসের (রিবা) ২০২১ সালের আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জন্য নির্বাচিতদের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বাংলাদেশের সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। রিবার ওয়েবসাইটে বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে।
মঙ্গলবার বিশ্বের ব্যতিক্রমী নকশার এই নতুন ভবনের সংক্ষিপ্ত তালিকা প্রকাশ করেছে রিবা। ৮০ শয্যার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতালের নকশা করেছেন স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী, যিনি এর আগে আগা খান স্থাপত্য পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। তার স্থাপত্য প্রতিষ্ঠান আরবানা ভবনটি নির্মাণ করেছে।
সংক্ষিপ্ত তালিকার বাকি দুটি স্থাপনা হল জার্মানির বার্লিনের জেমস-সায়মন-গ্যালারি এবং ডেনমার্কের কোপেনহেগেনের লিলে ল্যাঞ্জেব্রো সেতু।
বিশ্বের ১১টি দেশের ১৬টি ব্যতিক্রমী নতুন স্থাপনা থেকে বাছাই করে এই সংক্ষিপ্ত তালিকা চূড়ান্ত করেছে রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের পাঁচ সদস্যের জুরি বোর্ড। দ্বিবার্ষিক এ পুরস্কারের চূড়ান্ত বিজয়ীর নাম ঘোষণা করা হবে আগামী ২ ডিসেম্বর। রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের জুরি বোর্ড বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঝুঁকিতে থাকা দক্ষিণ বাংলার জলো পরিবেশে গড়ে তোলা হয়েছে সাতক্ষীরার ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল।
এ স্থাপনার বিশেষত্ব হচ্ছে, স্থানীয় প্রকৌশলীরা স্থানীয়ভাবে তৈরি নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে ভবনটি গড়েছেন। ভবনটি এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে যাতে প্রচুর আলো-বাতাস চলাচল করতে পারে। নিশ্চিত করা হয়েছে বিদ্যুতের সর্বনিম্ন ব্যবহার। পানি ধরে রাখার জন্য জলাধার রাখা হয়েছে। হাসপাতালের নিরাপত্তা, সহজে যাতায়াত ব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার প্রত্যক্ষ অঞ্চলের মানুষকে চিকিৎসা সেবা দিতে ২০১৮ সালের জুলাই মাসে চালু হয়েছে ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল। ২০১৩ সালে নকশা করার পর চার বছরে এর নির্মাণকাজ শেষ হয়।
স্থপতি কাশেফ মাহবুব চৌধুরী গণমাধ্যমকে বলেন, শ্যামনগর এলাকাটি জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে ক্ষতিগ্রস্ত। ভবন তৈরির সময় এ বিষয়টি মাথায় রাখতে হয়েছে।
“আমাদের বলা হয়েছে, হাসপাতালের সব সুবিধা থাকতে হবে, কিন্তু যে বাজেট দেওয়া হয়েছে, তা ছিল খুবই কম। এই স্থাপনাটির একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটা খুব কম বাজেটের মধ্যে করা হয়েছে। স্থানীয়ভাবে পাওয়া উপাদান, হাতে তৈরি ইট ব্যবহার করা হয়েছে। শ্রমিকরাও সব ওই এলাকার।”কাশেফ মাহবুব জানান, হাসপাতালের ইনডোর এবং আউটডোর দুটি আলাদা জায়গা। দুটি জায়গার নিরাপত্তা ব্যবস্থাও দুই রকম। এ কারণে পুরো ভবনকে দুটি ভাগ করার বিষয় ছিল। কিন্তু অপেক্ষাকৃত কম জায়গায় সীমানা প্রাচীর করলে সরু দুটি ভাগ হয়ে যেত। এ কারণে ১০ ফুট চওড়া একটি জলাধারের মাধ্যমে ইনডোর এবং আউটডোর আলাদা করে ফেলা হয়েছে।
“ইনডোরে প্রাইভেসির ব্যাপার আছে। আউটডোরে লোকজন যেন ইনডোরে চলে যেতে পারে সে ব্যবস্থা রাখতে ওই খালের মাধ্যমে ভাগ করলাম। লোকজন বহির্বিভাগ থেকে ইনডোর দেখতে পেলেও যেতে পারছে না।
“আরেকটা ব্যাপার হচ্ছে, পুরো হাসপাতালে যে বৃষ্টির পানি পড়ে তা জলাধার ধারণ করতে পারে। বাড়তি পানি সামনের একটা পুকুরে যায়। পুকুরের এই পানি দিয়ে ছোটখাট ধোয়ামোছা, গাছে পানি দেওয়া যায়।”
বাতাসের গতিপথ হিসাব করে হাসপাতালের ওয়ার্ডগুলো করা হয়েছে। ওয়ার্ডের সামনে রাখা হয়েছে উঠোনের মত খালি জায়গা। বুয়েট থেকে ১৯৯৫ সালে স্থাপত্যওবিদ্যা য় লেখাপড়া শেষ করে আর্কিটেক্ট ফার্ম আরবানা গড়ে তোলা কাশেফ মাহবুব বলেন, হাসপাতালের স্থাপত্য নকশা বাড়ি বা অন্য ভবন থেকে আলাদা। রোগী ও চিকিৎসকদের চলাচল, খাবারদাবার পরিবহন এবং বর্জ্য অপসারণের মতো বিষয়গুলো বিবেচনায় রাখতে হয়।“বিষয়টি জটিল। তবে আমরা এমনভাবে করেছি যে কোনোটির সঙ্গে কোনোটি ক্রস করবে না। আবাসিক এলাকাও আলাদা করে দিয়েছি।”
লবণাক্ত পানি শোধনের জন্য একটি ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্টও আছে এ ভবনে। স্থানীয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে অল্প খরচে সেটা বানানো হয়েছে।
রিবা আন্তর্জাতিক পুরস্কারের সংক্ষিপ্ত তালিকায় স্থান পাওয়ার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে এই স্থপতি বলেন, “প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের কাছে স্বাস্থ্য সেবা পৌঁছে দেওয়া যাচ্ছে এমন একটি স্থাপনার মাধ্যমে। বিষয়টি বিশ্বের নজরে এসেছে, এটাই বড় পাওয়া।
“আমাদের দেশের উন্নয়ন এখন ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু দেশে প্রচুর মানুষ, আমরা অনেক জায়গায় সেবা পৌঁছে দিতে পারছি না। শ্যামনগরের মত প্রত্যন্ত এলাকা ক্লাইমেট চেঞ্জের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত। সেখানকার মানুষ এখান থেকে চিকিৎসা পাচ্ছে। আর ওই স্থাপনাটা স্থাপত্যকর্মের মাধ্যমে, ডিজাইনের মাধ্যমে তুলে ধরতে পেরেছি।”
ফ্রেন্ডশিপ হাসপাতাল সাতক্ষীরার সহকারী ব্যবস্থাপক অসীম ক্রিস্টোফার রোজারিও বলেন, তাদের এ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ২৪ ঘণ্টা সেবা দেওয়া হয়। রয়েছে তিনটি অপারেশন থিয়েটার, নারী-পুরুষের ওয়ার্ড, একটি লেবার ওটি। নিউনেটাল কেয়ার ইউনিটে ইনকিউবেটর সুবিধাসহ নবজাতকদের চিকিৎসা দেওয়া হয়। বহির্বিভাগে চক্ষু, দন্ত, ফিজিওথেরাপি ইউনিট, পেইন সেন্টার, গাইনি, সার্জারি ইউনিট, সার্ভিক্যাল ক্যান্সার ও ট্রিটমেন্ট সেন্টার রয়েছে। পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য আধুনিক ল্যাবও রয়েছে এ হাসপাতালে।
“আমাদের এই হাসপাতালের বিশেষত্ব হচ্ছে, সব চিকিৎসকের এখানে থাকার ব্যবস্থা রয়েছে। কেউ বাইরে থাকেন না। আউটডোরে চিকিৎসকের ফি ১০০ টাকা। আর ৩০০ টাকায় বিশেষজ্ঞ কনসালটেন্ট দেখানো যায়। চালু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত প্রায় ৭২ হাজার মানুষ এই হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়েছে।”