বউ বাজারঃ যেখানে কুমারী মেয়েদের বাজারে তোলা হয় বিয়ের জন্য



'বউ বাজার' তাজ্জব ব্যাপার, শুনেই অবাক লাগার কথা। কিন্তু বাস্তবে সত্যিই এমন বাজার রয়েছে, যেখানে কুমারী মেয়েদের বাজারে তোলা হয় বিয়ের জন্য। সেখানে দেখে শুনে দরদাম করে নিতে পারবেন জীবন সঙ্গিনীকে। কখনো কখনো আবার ডিসকাউন্ট অফারও পাওয়া যায়।


অবিশ্বাস হলেও সত্যি এরকমই একটি বাজার বসে ইউরোপের দেশ বুলগেরিয়ায়। বছরে চারবার মেয়েদের সাজিয়ে-গুছিয়ে ওঠানো হয় এই মেলায়। দূর-দূরান্ত থেকে খদ্দেররা আসেন এই মেয়েদের বিয়ে করার জন্য। নগদ টাকা দিয়ে স্ত্রী হিসেবে মেয়েদের কিনে নেন তারা। দূর থেকে দেখে মনে হবে রঙের মেলা বসেছে শহরের প্রান্তে। কাছে গেলে ততটাই তাজ্জব হতে হয়। মেলার মতোই সাজানো গোছানো চারপাশ। জিনিসপত্র সাজিয়ে বসেছেন দোকানিরা। মানুষজন রং বেরঙের পোশাক পড়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন।


সবচেয়ে বেশি দৃষ্টি আকর্ষণ করে আধুনিক ও ঐতিহ্যবাহী সাজে এক ঝাঁক তরুণীর ভিড়। মডেলিংয়ের কায়দায় তারা হেঁটে বেড়াচ্ছে, নাচছে। আর পাশে তাদের অভিভাবকরা দাঁড়িয়ে জোরে জোরে নিলাম তুলছেন। যে মেয়ে যত সুন্দর তার দাম তত বেশি। একবিংশ শতকে এসে মেয়ে কেনা-বেচা এমনটা আবার হয় নাকি? জায়গাটা মধ্য বুলগেরিয়ার স্তারা জাগোরা। বসন্তের শুরুতে এখানে বসে বউ মেলার আসর। কুমারী মেয়ে বিক্রি হয় বলে অনেকে আবার কুমারী মেলাও বলে থাকেন।


মেলা নয়, এটা মূলত ‘ব্রাইড মার্কেট’ যার বাংলা অর্থ করলে দাঁড়ায় বউ কেনার হাট। শুনতে খারাপ লাগলেও এখানকার এক সম্প্রদায়ের কাছে এটাই ঐতিহ্য। এই সম্প্রদায়কে স্থানীয়রা কালাইদঝি বলে। তরুণী ও কুমারী মেয়ের বর খোঁজার জন্যই এমন হাটের আয়োজন। রীতিমতো নগদ টাকা দিয়ে কালাইদঝিরা তাদের মেয়েদের এই হাটে বিক্রি করে। এই হাটে ১৩ থেকে ২০ বছরের মেয়েদের চাহিদা বেশি। দাম অনেক। বয়স বাড়লে দামও কমে। প্রশ্ন জাগতেই পারে কারা এই কালাইদঝি? সভ্য ইউরোপের মাঝখানে এমন মধ্যযুগীয় কায়দায় মেয়েদের বেচা-কেনাইবা হয় কীভাবে?


কালাইদঝি হলো পূর্ব ইউরোপের এক প্রাচীন জনগোষ্ঠীর নাম।বুলগেরিয়ার খুব ছোট এক জনগোষ্ঠী রোমা, তারা রক্ষণশীল খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ। মূলত যাযাবর জাতি। এক জায়গায় থাকা তাদের অভ্যাস নেই। পূর্ব ইউরোপে এই সম্প্রদায়ের প্রায় ১৮ হাজার মানুষ বাস করে। তামার জিনিসপত্র তৈরি করা তাদের পেশা। এটা দিয়েই তাদের পেট চলে। তবে এখন কালাইদঝিরা নানা পেশার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছেন। অভাব তাদের নিত্যসঙ্গী। খুবই দরিদ্র এই লোকগুলো। তাই পছন্দের জীবনসঙ্গী খুঁজে নেয়ার জন্য এমন মেলার আয়োজন করে থাকে কালাইদঝিরা।


এটা তাদের রোজগারের একটি পন্থা। অনেকেই রোমা সম্প্রদায়ের এই রেওয়াজকে মধ্যযুগীয় বর্বরতা আখ্যা দিলেও তাদের কাছে এটা ঐতিহ্য এবং তারা এটিকে টাকা রোজগারের একটা উপায় হিসেবে দেখে থাকে। কেমন হয় এই ব্রাইড মার্কেট? বছরে চারবার এমন মেলার আয়োজন হয়। তবে বসন্তকালে এই মেলা কিছুটা আলাদা। আয়োজনটা হয় বড় করে। মূলত ফাঁকা মাঠেই হয় এলাহি আয়োজন। নির্ধারিত দিনে সকাল হতেই মেয়েদের সাজিয়ে গুজিয়ে বাবা-মায়েরা হাজির হয়ে যায় মেলার মাঠে। মঞ্চও তৈরি থাকে। যারা একটু বেশি টাকা-পয়সা খরচ করে, তারা মেয়েদের মঞ্চের উপর তুলে দেয়। তারপর শুরু হয় আইপিএলের নিলামের মতো দরদাম করা।


মেলায় বউ কিনতে নানা জায়গা থেকে হাজির হয় পুরুষেরা। নিলামের মতো করে যে পুরুষ বেশি দাম দেয় তার হাতেই মেয়েকে তুলে দেয় তাদের অভিভাবকরা। এই মেলায় তরুণীদের সাজ-পোশাকও দেখার মতো। পোশাকের সঙ্গে তাদের গয়না ও তাদের চুলের সাজ নজর কাড়ে পুরুষের। পছন্দের পাত্রী কেনার পাশাপাশি খাওয়া-দাওয়াও বেশ। গ্রিল করা মাংস আর বিয়ার থাকে তাদের পছন্দের তালিকায়। জীবনসঙ্গী পছন্দ হয়ে যাওয়ার পর নাচ-গান শুরু হয়। নাবালিকা বিয়ে এখানে বৈধ। এ কারণেই ১৩ থেকে ১৪ বছর বয়সের মেয়েরা বিক্রি হয় এই মেলায়। যদিও ইউরোপের বিভিন্ন এনজিও এবং নারী অধিকার কর্মীরা এই বউ মেলা বন্ধ করাও আন্দোলন করছেন।


রোমা সম্প্রদায়ের মেয়েরা এই বিয়েতে কতটা খুশি হয় বা আদৌ খুশি হয় কিনা সেই প্রশ্ন তাদের পরিবারের কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়। কালাইদঝিরা সব কিছুকেই তাদের রোজগারের পাল্লায় মাপে। এই লোকগুলোর কাছে পেট ভর্তি থাকাটাই বড় কথা। এই বিয়ের মূল শর্ত হলো মেয়েদের সতীর্থ। কুমারীত্ব হারিয়ে ফেললে তাকে দাম দিয়ে কেউ কিনবে না। তাই এই সম্প্রদায়ের মেয়েদের প্রথম পিরিয়ড হওয়ার পরে তাকে বাড়িতে বন্দি করে রাখা হয়। স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দেয় তাদের বাবা-মায়েরা। তাকে বাড়িতে একটু একটু করে বিয়ের জন্য প্রস্তুত করতে শুরু করে বাবা-মায়েরা। মেয়েকে শেখানো হয় কেমন আদব-কায়দা করলে তাকে একটি ছেলে পছন্দ হতে পারে। যে যত সুন্দরভাবে নিজেকে মেলে ধরবে, ততটাই দাম পাবে তার পরিবার।


এই কুমারী মেলা বা বউ মেলা কতটা সত্যি তা জানার জন্য অনেক বছর আগে দুই চিত্র পরিচালক, মিলেন লারসন ও এলিস টেম্পল বুলগেরিয়া গিয়েছিলেন। তারা জানিয়েছেন, এখানকার মেয়েদের অভিজ্ঞতা ভয়াবহ। বাইরে থেকে যতটা চাকচিক্য ভেতরে ততটা খুশি নন তারা। আড়াই লাখ টাকা থেকে পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত মেয়েদের দাম ওঠে। কম বয়সী সুন্দরী মেয়েদের দাম আরো বেশি।


অনেক মেয়ে জানিয়েছেন পাত্র পছন্দ না হলেও দাম বেশি দিলে তার হাতে হাত রাখতে হয়। অপছন্দের মানুষের সঙ্গে কাটাতে হয় সারাজীবন। তবে এতো কিছুর পরো কালাইদঝিরা তাদের এই সংস্কৃতি হারাতে চান না। তরুণ প্রজন্মেরা রাজি না থাকলেও তাদের বয়োজ্যেষ্ঠরা এই প্রথা নষ্ট করতে রাজি না। তারা তরুণী মেয়েদের তারা মেলায় অংশ নিতে বাধ্য করে। আর তারাও টাকার জন্য এই মেলায় অংশগ্রহণ করে থাকে।

Previous Post Next Post